পঞ্চম বা ষষ্ঠ হিজরির শাবান মাস। রাসুল (সা.) কে ঘিরে বসে আছেন তার সহধর্মিণীরা। অল্পসময়ের মধ্যে লটারি হবে। লটারিতে যার নাম ওঠবে তিনি হবেন আজকের ভাগ্যবতী। হবেন বনু মুস্তালিকা যুদ্ধে রাসুল (সা.) এর সফরসঙ্গী। প্রিয়নবী (সা.) যখন কোনো যুদ্ধ বা সফরের ইচ্ছা করতেন, তখন এভাবেই সহধর্মিণীদের মধ্য থেকে সফরসঙ্গী নির্বাচন করতেন। লটারিতে নাম উঠেছে আম্মাজান আয়েশা (রা.) এর। বনু মুস্তালিকার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন ভাগ্যবতী আয়েশা (রা.)। এ যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন মোমিন জননী। ইতিহাসে যা ইফকের ঘটনা হিসেবে পরিচিত। ‘ইফক’ অর্থ অপবাদ। আম্মাজান আয়েশা (রা.) এর বিরুদ্ধে চারিত্রিক অপবাদ। কী জঘন্য কথা! কত মর্মান্তিক অপবাদ! আজ জানব সে ঘটনা। জানব আল্লাহর পক্ষ থেকে আম্মাজানের চারিত্রিক সনদ লাভের অত্যাশ্চার্য কাহিনী। সিরাতে ইবনে হিসাম, আররাহিকুল মাখতুম, সিরাতে রাসুল পাক, মুহসিনে ইনসানিয়াত, ইবনে কাসির, মাজহারি ও মাআরেফুল কোরআনের বর্ণনার আলোকে সাজানো হয়েছে ঐতিহাসিক ‘ইফক’ বা অপবাদ রটনার ঘটনা।
বনু মুস্তালিকার যুদ্ধ শেষে রাসুল (সা.) ও সাহাবিরা মদিনার উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। রাতদিন অবিশ্রান্ত চলছে জান্নাতি কাফেলা। মদিনার কাছাকাছি আসতেই রাসুল (সা.) বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। ‘প্রয়োজনীয় কাজ’ও সারলেন অনেকে। কয়েক ঘণ্টা পর আবার কাফেলা চলার নির্দেশ দিলেন রাসুল (সা.)। আম্মাজান আয়েশা (রা.) প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ শেষে কাফেলায় এসে দেখেন সবাই গোছগাছ করছে। বলে রাখা ভালো, তখন ‘প্রাকৃতিক’ কাজ সারার জন্য নারী-পুরুষ সবাই লোকবসতি থেকে একটু দূরে নির্জন জায়গায় চলে যেত। আম্মাজানের বক্তব্য থেকে জানা যায়, তখন মেয়েরা রাতে এ কাজ সারতেন। যাতে দিনের বেলায় মানুষের নজরে পড়তে না হয়। আর এ অভ্যাস রপ্ত করার জন্য মেয়েরা খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রিতভাবে খেতেন। ফলে তাদের পেশাব-পায়খার প্রয়োজন হতো কম আবার শারীরিক বৃদ্ধিও ছিল হালকা গড়নের। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, কেউ চাইলে তার প্রাকৃতিক কাজ নির্দিষ্ট সময়ের আওতায় নিয়ে আসতে পারে। এর জন্য কয়েক দিনের অভ্যাসই যথেষ্ট। আম্মাজান থেকে আমরা আরেকটি বিষয় জানতে পারি, আম্মাজানের জন্য প্রথমে উটকে প্রস্তুত করা হতো। তারপর উটের পিঠের হাওদা (অনেকটা পালকির মতো) আনা হতো। আম্মাজান হাওদায় বসার পর লোকেরা তা নিয়ে উটের পিঠে বেঁধে দিত। আম্মাজানের গাড়ি চড়ার নিয়ম ছিল এরকম।
আম্মাজান আয়েশা (রা.) হাওদায় বসতে যাবেন এমন সময় গলায় হাত দিয়ে দেখেন ইয়েমেন থেকে উপহার পাওয়া মূল্যবান হারটি নেই। আমরা যারা এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছি তারা কিছুটা হলেও বুঝতে পারব আম্মাজানের অস্থিরতার বিষয়টি। আম্মাজান দৌড়ে চলে গেলেন প্রাকৃতিক কাজ সারার জায়গায়। সেখানে গিয়ে হার খুঁজে পেতে কিছু সময় লাগল। এদিকে লোকেরা হাওদা কাঁধে নিয়ে উটের পিঠে বেঁধে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু তারা বুঝতেই পারেনি ভেতরে আয়েশা (রা.) নেই। কারণ আগেই বলেছি, আম্মাজানের ওজন ছিল কম। আর হাওদাবাহকরা ভেবেছেন তিনি বুঝি ভেতরেই আছেন। আম্মাজান ফিরে এসে দেখেন কাফেলা চলে গেছে। তিনি হাহুতাশ না করে একটু বুদ্ধির পরিচয় দিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন সে কথা। ‘যখন দেখলাম কাফেলা নেই, তখন আমি ভাবলাম এখানেই শুয়ে থাকি। যখন তারা জানতে পারবে আমি হাওদায় নেই, অবশ্যই তারা খোঁজ করতে এখানে আসবে। এই ভেবে আমি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।’
কাফেলার পেছনে দায়িত্বে ছিলেন সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল (রা.)। সবাই চলে যাওয়ার পর কিছু রয়ে গেল কিনা, তা খোঁজে রওনা করতেন তিনি। অনেকে বলেছেন, এ সাহাবি ঘুমকাতুরে স্বভাবের ছিলেন। তাই রাসুল (সা.) কৌশল করে তার রুচিমতো কাজটিই দিলেন তাকে। ঘুমও হলো, কাফেলার পেছনে পড়ে থাকা জিনিসপত্র সংগ্রহের দায়িত্বও আদায় হলো। একটু পর সাফওয়ান (রা.) আয়েশা (রা.) কে দেখলেন। আম্মাজানকে দেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো ‘ইন্নালিল্লাহ! এ যে নবী (সা.) এর স্ত্রী! আমাদের আম্মাজান। আল্লাহ আপনার ওপর রহমত বর্ষণ করুন। আপনি কীভাবে পেছনে পড়ে গেলন?’
আম্মাজান কথার কোনো উত্তর করলেন না। সাফওয়ান (রা.) নিজের উট আম্মাজানের উদ্দেশে এগিয়ে আনলেন। আর তিনি দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আম্মাজান উটে সওয়ার হওয়ার পর সাফওয়ান (রা.) উটের রশি ধরে চলতে লাগলেন। সকালের একটু পর মদিনায় পৌঁছে দেখেন সবাই বিশ্রাম করছে। তখনও কেউ বুঝতে পারেনি আম্মাজান এতক্ষণ কাফেলায় ছিল না। সাফওয়ানের হাতে রশি আর আয়েশা (রা.) কে উপরে দেখে মুনাফেক সর্দার ইবনে উবাই চিৎকার করে বলে ওঠল, ‘আল্লাহর কসম! এ মহিলা নিষ্কলঙ্ক হয়ে আসেনি। দেখ! তোমাদের নবীর স্ত্রী পরপুরুষের সঙ্গে রাত কাটিয়ে এসেছে। আবার প্রকাশ্যে তাকে নিয়ে মদিনায় ঢুকেছে।’ নাউজুবিল্লাহ। একজন মানুষের মন কত নিচু হলে একজন সম্ভ্রান্ত রমণী সম্পর্কে এমন নিচু মন্তব্য করতে পারে।
সফরের ধকল সইতে না পেরে আম্মাজান আয়েশা (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। আম্মাজান বলেন, বাইরে এত কানাঘুষা চলছে; কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি কোনো সমস্যা হয়েছে। রাসুল (সা.) আমার সঙ্গে আগের মতো স্বাভাবিক আচরণ করছেন না। আগে অসুস্থ হলে তিনি আমার সেবা করতেন। কিন্তু এবার বাইরে থেকেই জিজ্ঞেস করতেন, ‘ওর এখন কী অবস্থা’? এক রাতে আমি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য মদিনার বাইরে গেলাম। আমার সঙ্গে ছিল মিসতাহ (রা.) এর মা। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আমাকে সব ঘটনা খুলে বললেন। এসব কথা শুনে আমার আর টয়লেট করার প্রবৃত্তি রইল না। আমার পুরো রাত কেটেছে চোখের জলে। কান্না যেন থামাতেই পারছিলাম না।
রাসুল (সা.) উসামা (রা.) ও আলী (রা.) কে নিয়ে পরামর্শে বসলেন। বাইরে এত কঠিন অবস্থা! এ মুহূর্তে কী করা যায়? উসামা (রা.) বললেন, ‘আমি আম্মাজানের বিষয়ে ভালো বৈ খারাপ কিছু জানি না।’ আলী (রা.) বললেন, ‘একজন মহিলার বিষয় আপনাকে এত চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে, তা আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না। আপনি চাইলে আয়েশা (রা.) এর জায়গায় অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন। আর এ বিষয়ে যদি সত্যিটাই জানতে চান তবে তার দাসীকে জিজ্ঞেস করুন। সেই সঠিক কথা বলতে পারবেন।’ দাসী বলল, ‘আল্লাহর কসম! আয়েশা সম্পর্কে ভালো ছাড়া খারাপ কিছু জানি না।’ এরপর রাসুল (রা.) মসজিদে নববিতে এসে একটি ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘হে মুসলমানরা! এক ব্যক্তি আমার পরিবারের ওপর মিথ্যা দোষারোপ করে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। তোমাদের মধ্যে কে আছ যে তার আক্রমণ থেকে আমার ইজ্জত বাঁচাতে পারবে? আল্লাহর কসম! আমি আমার স্ত্রীর মধ্যে খারাপ কিছু দেখিনি, আবার সাফওয়ানের ব্যাপারেও খারাপ কিছু জানি না। সে কখনও আমার অনুপস্থিতিতে আমার বাড়িতে আসেনি।’ রাসুল (সা.) এর রাগমিশ্রিত আবেগঘন ভাষণ শুনে মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবীর বাদশাহ কতটা অসহায় এক মোনাফেকের কাছে। এ অবস্থা দেখে সাহাবিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। রাসুল (সা.) তাদের শান্ত করে ঘরে চলে আসেন।
এভাবে ১ মাসের বেশি অতিবাহিত হলো। আমি আমার বাবার ঘরে চলে এলাম। রাসুর (সা.) প্রচ- মানসিক কষ্টে ভুগলেন। তিনি কী করবেন ভেবে পেলেন না। আমার দিন কাটছে চোখের পানিতে। একদিন রাসুল (সা.) আমার কাছে এলেন। সামনে আমার মা-বাবাও বসা ছিল। রাসুল (সা.) বললেন, ‘আয়েশা! তুমি যদি সত্যিই কোনো অপরাধ করে থাকো তবে তওবা করো। আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন।’ এ কথা শুনে আমি প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। আমার ধারণা ছিল আর কেউ না হোক রাসুল (সা.) আমার সঙ্গে আছেন। এখন মনে হলো আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই। বাইরে আমাকে দেখে শান্ত মনে হলেও ভেতরে আমার তোলপাড় করতে লাগল। আমি ভাবলাম আমার আব্বা-আম্মা আমার পক্ষ থেকে রাসুল (সা.) কে কিছু বলবেন। কিন্তু হায়! তারা কিছুই বলেননি। তখন আমি বলতে শুরু করলাম, ‘আপনাদের কানে একটি কথা এসেছে আর তা মনে গেঁথে গেছে। এখন আমি যদি বলি আমি নিরপরাধ তবে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি তওবা করি তবে আমার অপরাধ স্বীকার করা হবে। অথচ তা থেকে আমি মুক্ত। সুতরাং আমি ধৈর্য অবলম্বন করলাম।’ এ কথা বলেই আম্মাজান অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়েন।
আম্মাজান বলেন, আমি শুয়ে শুয়ে ভাবছি, যেহেতু আমি কোনো অপরাধ করিনি তাই আমার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আল্লাহ তায়ালা কোনো না কোনো মাধ্যমে তার হাবিবের অন্তরে প্রশান্তির জন্য সঠিক ঘটনা জানিয়ে দেবেন। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি কোরআনে আমার পবিত্রতার ঘোষণা আসবে। আর কেয়ামত পর্যন্ত তা তেলাওয়াত হবে।’ এমন সময় রাসুল (সা.) এর ওপর ওহি নাজিল হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেল। প্রচ- শীতে তিনি দরদর করে ঘামতে লাগলেন। এ অবস্থা দেখে আবুবকর ও তার স্ত্রী ভয় পেয়ে গেলেন। না জানি মেয়ের বিপক্ষে ওহি নাজিল হয়ে যায়। কিন্তু আম্মাজান একদমই ভয় পেলেন না। কারণ তিনি জানেন তিনি কোনো অপরাধ করেননি। রাসুল (সা.) স্বাভাবিক হয়ে চোখ মেলে আয়েশা (রা.) এর দিকে তাকালেন। বললেন, ‘মোবারক হো আয়েশা! আল্লাহ তোমার নির্দোষিতার ব্যাপারে আয়াত নাজিল করেছেন।’ এরপর রাসুল (সা.) সূরা নূরের ১১ থেকে ২০ নং আয়াত তেলাওয়াত করলেন। আম্মাজানসহ সবার মনে স্বস্তি ফিরে এলো। সবাই আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। আলহামদুলিল্লাহ।
বনু মুস্তালিকার যুদ্ধ শেষে রাসুল (সা.) ও সাহাবিরা মদিনার উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। রাতদিন অবিশ্রান্ত চলছে জান্নাতি কাফেলা। মদিনার কাছাকাছি আসতেই রাসুল (সা.) বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। ‘প্রয়োজনীয় কাজ’ও সারলেন অনেকে। কয়েক ঘণ্টা পর আবার কাফেলা চলার নির্দেশ দিলেন রাসুল (সা.)। আম্মাজান আয়েশা (রা.) প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ শেষে কাফেলায় এসে দেখেন সবাই গোছগাছ করছে। বলে রাখা ভালো, তখন ‘প্রাকৃতিক’ কাজ সারার জন্য নারী-পুরুষ সবাই লোকবসতি থেকে একটু দূরে নির্জন জায়গায় চলে যেত। আম্মাজানের বক্তব্য থেকে জানা যায়, তখন মেয়েরা রাতে এ কাজ সারতেন। যাতে দিনের বেলায় মানুষের নজরে পড়তে না হয়। আর এ অভ্যাস রপ্ত করার জন্য মেয়েরা খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রিতভাবে খেতেন। ফলে তাদের পেশাব-পায়খার প্রয়োজন হতো কম আবার শারীরিক বৃদ্ধিও ছিল হালকা গড়নের। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, কেউ চাইলে তার প্রাকৃতিক কাজ নির্দিষ্ট সময়ের আওতায় নিয়ে আসতে পারে। এর জন্য কয়েক দিনের অভ্যাসই যথেষ্ট। আম্মাজান থেকে আমরা আরেকটি বিষয় জানতে পারি, আম্মাজানের জন্য প্রথমে উটকে প্রস্তুত করা হতো। তারপর উটের পিঠের হাওদা (অনেকটা পালকির মতো) আনা হতো। আম্মাজান হাওদায় বসার পর লোকেরা তা নিয়ে উটের পিঠে বেঁধে দিত। আম্মাজানের গাড়ি চড়ার নিয়ম ছিল এরকম।
আম্মাজান আয়েশা (রা.) হাওদায় বসতে যাবেন এমন সময় গলায় হাত দিয়ে দেখেন ইয়েমেন থেকে উপহার পাওয়া মূল্যবান হারটি নেই। আমরা যারা এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছি তারা কিছুটা হলেও বুঝতে পারব আম্মাজানের অস্থিরতার বিষয়টি। আম্মাজান দৌড়ে চলে গেলেন প্রাকৃতিক কাজ সারার জায়গায়। সেখানে গিয়ে হার খুঁজে পেতে কিছু সময় লাগল। এদিকে লোকেরা হাওদা কাঁধে নিয়ে উটের পিঠে বেঁধে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু তারা বুঝতেই পারেনি ভেতরে আয়েশা (রা.) নেই। কারণ আগেই বলেছি, আম্মাজানের ওজন ছিল কম। আর হাওদাবাহকরা ভেবেছেন তিনি বুঝি ভেতরেই আছেন। আম্মাজান ফিরে এসে দেখেন কাফেলা চলে গেছে। তিনি হাহুতাশ না করে একটু বুদ্ধির পরিচয় দিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন সে কথা। ‘যখন দেখলাম কাফেলা নেই, তখন আমি ভাবলাম এখানেই শুয়ে থাকি। যখন তারা জানতে পারবে আমি হাওদায় নেই, অবশ্যই তারা খোঁজ করতে এখানে আসবে। এই ভেবে আমি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।’
কাফেলার পেছনে দায়িত্বে ছিলেন সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল (রা.)। সবাই চলে যাওয়ার পর কিছু রয়ে গেল কিনা, তা খোঁজে রওনা করতেন তিনি। অনেকে বলেছেন, এ সাহাবি ঘুমকাতুরে স্বভাবের ছিলেন। তাই রাসুল (সা.) কৌশল করে তার রুচিমতো কাজটিই দিলেন তাকে। ঘুমও হলো, কাফেলার পেছনে পড়ে থাকা জিনিসপত্র সংগ্রহের দায়িত্বও আদায় হলো। একটু পর সাফওয়ান (রা.) আয়েশা (রা.) কে দেখলেন। আম্মাজানকে দেখে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো ‘ইন্নালিল্লাহ! এ যে নবী (সা.) এর স্ত্রী! আমাদের আম্মাজান। আল্লাহ আপনার ওপর রহমত বর্ষণ করুন। আপনি কীভাবে পেছনে পড়ে গেলন?’
আম্মাজান কথার কোনো উত্তর করলেন না। সাফওয়ান (রা.) নিজের উট আম্মাজানের উদ্দেশে এগিয়ে আনলেন। আর তিনি দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আম্মাজান উটে সওয়ার হওয়ার পর সাফওয়ান (রা.) উটের রশি ধরে চলতে লাগলেন। সকালের একটু পর মদিনায় পৌঁছে দেখেন সবাই বিশ্রাম করছে। তখনও কেউ বুঝতে পারেনি আম্মাজান এতক্ষণ কাফেলায় ছিল না। সাফওয়ানের হাতে রশি আর আয়েশা (রা.) কে উপরে দেখে মুনাফেক সর্দার ইবনে উবাই চিৎকার করে বলে ওঠল, ‘আল্লাহর কসম! এ মহিলা নিষ্কলঙ্ক হয়ে আসেনি। দেখ! তোমাদের নবীর স্ত্রী পরপুরুষের সঙ্গে রাত কাটিয়ে এসেছে। আবার প্রকাশ্যে তাকে নিয়ে মদিনায় ঢুকেছে।’ নাউজুবিল্লাহ। একজন মানুষের মন কত নিচু হলে একজন সম্ভ্রান্ত রমণী সম্পর্কে এমন নিচু মন্তব্য করতে পারে।
সফরের ধকল সইতে না পেরে আম্মাজান আয়েশা (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। আম্মাজান বলেন, বাইরে এত কানাঘুষা চলছে; কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি কোনো সমস্যা হয়েছে। রাসুল (সা.) আমার সঙ্গে আগের মতো স্বাভাবিক আচরণ করছেন না। আগে অসুস্থ হলে তিনি আমার সেবা করতেন। কিন্তু এবার বাইরে থেকেই জিজ্ঞেস করতেন, ‘ওর এখন কী অবস্থা’? এক রাতে আমি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য মদিনার বাইরে গেলাম। আমার সঙ্গে ছিল মিসতাহ (রা.) এর মা। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আমাকে সব ঘটনা খুলে বললেন। এসব কথা শুনে আমার আর টয়লেট করার প্রবৃত্তি রইল না। আমার পুরো রাত কেটেছে চোখের জলে। কান্না যেন থামাতেই পারছিলাম না।
রাসুল (সা.) উসামা (রা.) ও আলী (রা.) কে নিয়ে পরামর্শে বসলেন। বাইরে এত কঠিন অবস্থা! এ মুহূর্তে কী করা যায়? উসামা (রা.) বললেন, ‘আমি আম্মাজানের বিষয়ে ভালো বৈ খারাপ কিছু জানি না।’ আলী (রা.) বললেন, ‘একজন মহিলার বিষয় আপনাকে এত চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে, তা আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না। আপনি চাইলে আয়েশা (রা.) এর জায়গায় অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন। আর এ বিষয়ে যদি সত্যিটাই জানতে চান তবে তার দাসীকে জিজ্ঞেস করুন। সেই সঠিক কথা বলতে পারবেন।’ দাসী বলল, ‘আল্লাহর কসম! আয়েশা সম্পর্কে ভালো ছাড়া খারাপ কিছু জানি না।’ এরপর রাসুল (রা.) মসজিদে নববিতে এসে একটি ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘হে মুসলমানরা! এক ব্যক্তি আমার পরিবারের ওপর মিথ্যা দোষারোপ করে আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। তোমাদের মধ্যে কে আছ যে তার আক্রমণ থেকে আমার ইজ্জত বাঁচাতে পারবে? আল্লাহর কসম! আমি আমার স্ত্রীর মধ্যে খারাপ কিছু দেখিনি, আবার সাফওয়ানের ব্যাপারেও খারাপ কিছু জানি না। সে কখনও আমার অনুপস্থিতিতে আমার বাড়িতে আসেনি।’ রাসুল (সা.) এর রাগমিশ্রিত আবেগঘন ভাষণ শুনে মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবীর বাদশাহ কতটা অসহায় এক মোনাফেকের কাছে। এ অবস্থা দেখে সাহাবিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। রাসুল (সা.) তাদের শান্ত করে ঘরে চলে আসেন।
এভাবে ১ মাসের বেশি অতিবাহিত হলো। আমি আমার বাবার ঘরে চলে এলাম। রাসুর (সা.) প্রচ- মানসিক কষ্টে ভুগলেন। তিনি কী করবেন ভেবে পেলেন না। আমার দিন কাটছে চোখের পানিতে। একদিন রাসুল (সা.) আমার কাছে এলেন। সামনে আমার মা-বাবাও বসা ছিল। রাসুল (সা.) বললেন, ‘আয়েশা! তুমি যদি সত্যিই কোনো অপরাধ করে থাকো তবে তওবা করো। আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন।’ এ কথা শুনে আমি প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। আমার ধারণা ছিল আর কেউ না হোক রাসুল (সা.) আমার সঙ্গে আছেন। এখন মনে হলো আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই। বাইরে আমাকে দেখে শান্ত মনে হলেও ভেতরে আমার তোলপাড় করতে লাগল। আমি ভাবলাম আমার আব্বা-আম্মা আমার পক্ষ থেকে রাসুল (সা.) কে কিছু বলবেন। কিন্তু হায়! তারা কিছুই বলেননি। তখন আমি বলতে শুরু করলাম, ‘আপনাদের কানে একটি কথা এসেছে আর তা মনে গেঁথে গেছে। এখন আমি যদি বলি আমি নিরপরাধ তবে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি তওবা করি তবে আমার অপরাধ স্বীকার করা হবে। অথচ তা থেকে আমি মুক্ত। সুতরাং আমি ধৈর্য অবলম্বন করলাম।’ এ কথা বলেই আম্মাজান অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়েন।
আম্মাজান বলেন, আমি শুয়ে শুয়ে ভাবছি, যেহেতু আমি কোনো অপরাধ করিনি তাই আমার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আল্লাহ তায়ালা কোনো না কোনো মাধ্যমে তার হাবিবের অন্তরে প্রশান্তির জন্য সঠিক ঘটনা জানিয়ে দেবেন। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি কোরআনে আমার পবিত্রতার ঘোষণা আসবে। আর কেয়ামত পর্যন্ত তা তেলাওয়াত হবে।’ এমন সময় রাসুল (সা.) এর ওপর ওহি নাজিল হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেল। প্রচ- শীতে তিনি দরদর করে ঘামতে লাগলেন। এ অবস্থা দেখে আবুবকর ও তার স্ত্রী ভয় পেয়ে গেলেন। না জানি মেয়ের বিপক্ষে ওহি নাজিল হয়ে যায়। কিন্তু আম্মাজান একদমই ভয় পেলেন না। কারণ তিনি জানেন তিনি কোনো অপরাধ করেননি। রাসুল (সা.) স্বাভাবিক হয়ে চোখ মেলে আয়েশা (রা.) এর দিকে তাকালেন। বললেন, ‘মোবারক হো আয়েশা! আল্লাহ তোমার নির্দোষিতার ব্যাপারে আয়াত নাজিল করেছেন।’ এরপর রাসুল (সা.) সূরা নূরের ১১ থেকে ২০ নং আয়াত তেলাওয়াত করলেন। আম্মাজানসহ সবার মনে স্বস্তি ফিরে এলো। সবাই আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। আলহামদুলিল্লাহ।
মূল লিখা :

0 Comments